শিরোনাম
Passenger Voice | ০২:৩১ পিএম, ২০২৪-০৪-০৮
ঈদ বকশিশের নামে নানান কৌশলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে বিপণিবিতান, ফুটপাত সর্বত্র এখন নীরব চাঁদাবাজির মহোৎসব। চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে ফুটপাতের দোকানদাররাও। এমনকি ঈদ উপলক্ষ্যে এলাকায় আলোকসজ্জার নামেও চাওয়া হচ্ছে চাঁদা। অনেক ক্ষেত্রে হাসিমুখে বকশিশের নামে চাঁদা চাওয়ায় কেউ অভিযোগও করতে পারছেন না। তবে চাঁদা দিতে বাধ্য করার ঘটনাও কম নয়। বিপদে পড়ার আশঙ্কায় ভুক্তভোগীরা থানা পুলিশের দারস্থ হচ্ছেন না। আবার বড় চাঁদার চাপ সামলাতে কেউ কেউ ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে চলে গেছেন বলে শোনা যায়। কেউ আবার জরুরি কাজের অজুহাতে বিদেশে অবস্থান করছেন। সরেজমিন অনুসন্ধানসহ বিভিন্ন সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
রাজধানীর নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনীচক মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এবারের রোজার সময়ে এমনিতেই কাপড় কেনাবেচা কম হচ্ছে, তার ওপর ভর করেছে বকশিশ বা উপরি নামের চাঁদাবাজির খক্ষ। এক ব্যবসায়ী বলেন, ভবিষ্যতে এই জায়গায় ব্যবসা করে খেতে হবে। এই কারণে থানা পুলিশের দ্বারস্থ না হয়ে নীরবে আবদার পূরণ করি।
জানা গেছে, কোনো কোনো শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীর কাছে জাকাতের কাপড়, লুঙ্গি, থ্রিপিস ইত্যাদি দেওয়ার জন্য আগেই সালাম পৌঁছে দিয়েছেন একশ্রেণির অসৎ রাজনীতিক। আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ঈদ সেলামির নামে বাড়তি টাকা। থেমে নেই বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাও। তারা বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে ঈদ বকশিশের নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বাড়তি ঝামেলার ভয়ে কেউ থানা পুলিশের দ্বারস্থ হন না। আবার টাকা না দিলে হুমকি-ধমকি দিয় ভয় দেখানোর ঘটনাও ঘটছে। তবে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসন রয়েছে কঠোর অবস্থানে। কিন্তু বন্ধ হয়নি নীরব চাঁদাবাজি। ভুক্তভোগীরা জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় মুখ খুলতে নারাজ।
গত কয়েকদিন সরেজমিন রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, চাঁদনীচক, রাজধানী সুপার মার্কেট, ইসলামপুর কাপড় বাজার, কেরানীগঞ্জ কাপড় বাজার, খিলগাঁও তালতলা মার্কেট, খিলগাঁও রেলগেট বাজার, মালিবাগ সুপার মার্কেট, মালিবাগ বাজার, মৌচাক, ফরচুন সুপার মার্কেট, আনারকলি মার্কেট ছাড়াও ফার্মগেট, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকার মার্কেট ও ফুটপাতে ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে চাঁদাবাজির তথ্য।
এদিকে মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় ঈদ উপলক্ষ্যে আলোকসজ্জার নামে কার্ড ছাপিয়ে বাড়ির মালিকদের কাছে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক বাড়ির মালিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী বলেন, ভোলার গলির রনিগ্রুপের সদস্যরা এলাকা লাইটিং করার নামে তার কাছে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। পরে তিনি তাদের ৫০০ টাকা দেন। এভাবে মিরপুর ১৩ নম্বর এলাকার বিভিন্ন দোকান ও বাসাবাড়ি থেকে টাকা উত্তোলন করছে এই গ্রুপের সদস্যরা।
ঈদ বকশিশের নামে চাঁদাবাজির বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগীরা বলেন, এলাকার স্থানীয় সন্ত্রাসী, মাস্তান ছাড়াও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ক্যাডাররা সালাম দিচ্ছেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের। তারা ঈদের সময়ে এলাকার গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করার নামেও বকশিশের নামে চাঁদা আদায়ের কৌশল অবলম্বন করছে। তাদের একেকজনের বকশিশ আদায়ের ধরন একেক রকম। তারা ঈদ বকশিশের জন্য ফোন করে চাচা, মামা কিংবা ভাইজান সম্বোধন করে সালাম দেন। এরপর বলেন, বস ঈদ করাবেন না? কেউ কেউ আবার ছন্দ মিলিয়ে বলেন, ‘বড় ভাইয়ের সালাম নিন, ঈদ আনন্দের বকশিশ দিন।’ নরম কথায় কাজ না হলে গরম কথায় ভয়ভীতি দেখানো হয়। যে ব্যবসায়ী যত বড়, তার কাছে বকশিশ বা চাঁদার অঙ্কও তত বেশি। যে মাস্তান যত বড় তার চাঁদাবাজির নজরানাও তত বড়। ব্যবসায়ীদের অনেকেই ঝক্কিঝামেলা এড়াতে কমবেশি যা হোক একটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ঝামেলা মেটাচ্ছেন।
ঈদকে সামনে রেখে মিরপুর-১, দারুস সালাম, বেড়িবাঁধ এলাকার চাঁদাবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঈদের দোহাই দিয়ে তারা ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতার নাম ভাঙিয়ে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এসব চাঁদাবাজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মিরপুর বেড়িবাঁধ কাঁচাবাজারে আড়তসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী, ফুটপাতের হকাররা। এদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছেন না বিভিন্ন মার্কেটে পজিশন নিয়ে বসা ব্যবসায়ী, স্থানীয় লেগুনা স্ট্যান্ডগুলোর মালিক ও চালকরা। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ঈদকে সামনে রেখে এবার দ্বিগুণের চেয়েও বেশি চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ এই এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন খাইরুল, রতন ও জনি। তাদের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্ন ভাগে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে চাঁদা তুলছে।
মিরপুর বেড়িবাঁধের কাঁচামালের আড়তের ব্যবসায়ী আবুল কালাম জানান, নতুন নতুন মাস্তানরা বিভিন্ন এমপি, নেতা, পুলিশ কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদার দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছে। না দিলে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই আড়তে সাড়ে ৫০০ আড়তদার রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে নতুন হারে চাঁদা তোলা হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও। এমনকি বাজারকেন্দ্রিক রিকশা, ভ্যান, পিকআপ ট্রাক, ঠেলাগাড়ি থেকেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। প্রতিদিন শুধু বাজারকেন্দ্রিক চাঁদা তোলা হচ্ছে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। যা মাসে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকায় দাঁড়াচ্ছে।
স্থানীয় লাইনম্যান তৈয়ব আলী জানান, সম্প্রতি খাইরুল, রতন ও জনি তার কাছ থেকে প্রতিমাসে ৭ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছেন। এই টাকা দিতে না পারলে তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে লাইন চালানোর হুমকি দিয়েছেন তারা।
একজন লেগুনাচালক জানান, নতুন নতুন হারে চাঁদা আদায়ের দাবি নিয়ে হাজির হয় চাঁদাবাজরা। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে লেগুনাচালকদের বেশিরভাগ সময় কথা কাটাকাটি হয়। আর তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে চাঁদাবাজরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। তাদের মাস্তানিতে যাত্রীরাও ভয় পান। এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে কল করা হলে রতন যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়। আমি রাজনীতি করি, তাই আমার প্রতিপক্ষ আমাকে ঘায়েল করতে এসব রটাচ্ছে। জনি যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসন যদি আমাদের বিরুদ্ধে তদন্তে চাঁদাবাজির অভিযোগ পায়, তবে ব্যবস্থা নেবে। আমি এতে জড়িত নই। আর খায়রুলকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করে কেটে দেন। এদিকে গত ৪ এপ্রিল রাতে কদমতলীর জুরাইন এলাকা থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
এদিকে বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসির আরাফাত জানান, গত ৬ এপ্রিল বিমানবন্দর এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজির অভিযোগে ৮ জনকে সাজা দিয়েছেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ডিএমপি কমিশনার স্যারের নির্দেশনায় ৫ জন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য ও ৩ জন ছিনতাইকারীসহ মোট ৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
ব্যবসায়ীদের সূত্র জানায়, সরকারি হিসাবে রাজধানীতে প্রায় ১৪৭টি শপিংমল রয়েছে। বাস্তবে এর সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। আর এসব শপিংমলে অন্তত লাখখানেক ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার, এক লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা কাছে দাবি করেন, বিগত বছরগুলোর ঈদের তুলনায় এবারের ঈদে চাঁদাবাজদের উৎপাত একটু কম। বিশেষ করে টপটেররদের নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে টেলিফোনে চাঁদাবাজি অনেকটা কমে এসেছে। তবে সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে মাস্তানদের বকশিশ চাঁদাবাজি চলছে খুবই নীরবে।
চাঁদাবাজির বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে র্যাবের নীতি জিরো টলারেন্স। চাঁদাবাজসহ অন্য অপরাধীদের বিরুদ্ধেও অভিযান চলমান রয়েছে। এদিকে ছিনতাই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। সূত্র বলছে, চাঁদাবাজি বন্ধে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণসহ বিশেষ মনিটরিং করছেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ইতোমধ্যে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, কোনো ধরনের চাঁদাবাজি বরদাশত করা হবে না। সব ধরনের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে সংকট কাটছে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী এবং কৌশলে বড় অঙ্কের চাঁদাবাজিতে যুক্ত প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ভুক্তভোগীদের নেই। মূলত এ কারণেই নীরবে চাঁদাবাজি বিস্তার লাভ করছে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2019 - 2024 PassengerVoice | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Developed By Muktodhara Technology Limited.